ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বাজেট পুরোটাই ব্যবসাবান্ধব

প্রস্তাবিত বাজেট পুরোটাই ব্যবসাবান্ধব-এমন মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ নেবেন। আর সুযোগ নেওয়ার অর্থ হচ্ছে তারা উৎপাদনে যাবেন। উৎপাদনে গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবেন। এ বছর ভ্যাট ও করে যে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়েছে-এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজস্ব আহরণ ও বিনিয়োগ বাড়ানো। 

শুক্রবার বাজেটোত্তর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, পুরো অর্থনীতির চালকের সিটে থাকবে বেসরকারি খাত। তাদের সহায়তা আমরা করব। তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে অর্থনীতি। এক্ষেত্রে রাজস্ব নীতি বড় ধরনের সহায়তা করতে পারবে। যে কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতিকে সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে রাজস্ব নীতি দিয়ে। 

কালোটাকা সাদা করার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এর পক্ষে ও বিপক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। এ জন্য সমীক্ষা করে দেখা হচ্ছে বিষয়টি। এ বিশেষ সুযোগ লাভজনক হলে তা অব্যাহত থাকবে আগামীতেও। তবে আরও পরে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, কর হার ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ করে রাখা হয়েছে। আমি মনে করি এটি অনেক বেশি, ব্যবসায়ীদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। কোনো এক সময় ছিল সুপার ইনকাম ট্যাক্স। অর্থাৎ যারা বেশি আয় করবেন তারাই বেশি কর দেবেন। কিন্তু উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল। যারা সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে আয় করবেন তাদের আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া দরকার ছিল। সেটা কখনো করা হয়নি। এজন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ বিষয় দেখে নীতি সহজ করে যেটি সর্বজনীন করার দরকার, সেটি করা হয়েছে। এবার বাজেটে যা পাওয়া গেছে এখানে স্থির থাকব না। আগামীতে আমরা আরও উদার থাকব। ট্যাক্স বলেন, ভ্যাট বলেন, মূসক বলেন সব রেট কমাব। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজস্ব আদায়কে আরও সম্প্রাসরণ করা-এটি মনে রাখতে হবে।

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনবিআর) আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিম, অর্থসচিব (সিনিয়র) আবদুর রউফ তালুকদার, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম প্রমুখ।

বৃহস্পতিবার মহামারির মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। রীতি অনুযায়ী, প্রতি বছর জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করার পরের দিন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে সংবাদ সম্মেলনের অংশগ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী। সে মোতাবেক এবারও তা আয়োজন করা হয়। তবে করোনার কারণে সেটি ভার্চুয়ালি (জুম) আয়োজন করা হয়। সেখানে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষা করে জীবিকার সুযোগ করে দেবে এবং উন্নয়ন ঘটাবে। আমি মনে করি ব্যবসায়ীরা কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজটি করবে। আমরা মেইড ইন বাংলাদেশের ট্যাগলাইনটা ব্যবহার করতে শুরু করেছি। এটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ। আমাদের দেশীয় পণ্য যেগুলো আছে। যেখানেই সম্ভাবনা আছে, সক্ষমতা আছে, আমরা সেটাকে কাজে লাগাব।

রাজস্ব আহরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইন সহজ করে প্রকৃত করদাতাদের লক্ষ্য করে এ যাত্রায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে রাজস্ব আয় অনেক বেশি হবে। এর আগে বিশ্বের অনেক দেশ আমেরিকাসহ চেষ্টা করেছে কর হার বেশি নির্ধারণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো। আমি মনে করি, ধীরে ধীরে কর হার কমালে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে কর হার ছাড় দেওয়ার পেছনে আমার বিশ্বাস যে আমরা বিজয়ী হয়েছি। করদাতা এবং আমরা উভয়ে বিজয়ী হয়েছি। মূলত কর হার কমানো হয়েছে বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি আদায়ের জন্য।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যবসা পরিবর্তনশীল। প্রত্যেক সময়ে মানুষের চাহিদা পরিবর্তন হয়। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদেরও পরিবর্তন আসে। ফলে ব্যবসায়িক কর, ভ্যাট কখনোই ফিক্সড (একই হার) রাখা যাবে না। আমাদের পরিস্থিতিতে কী চাহিদা এবং সারা বিশ্বের কী চাহিদা-এসব দিক বিবেচনা করেই সব কিছু নির্ধারণ করতে হয়।

অতীতের বাজেটগুলোতে অর্থনীতি ঠিক রাখতে মুদ্রানীতি দিয়ে সাপোর্ট (সহায়তা) দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কখনোই রাজস্ব নীতি দিয়ে অর্থনীতিকে সাপোর্ট দেওয়া হয়নি। এটি ছিল ভুল। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতিকে সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে রাজস্ব নীতি দিয়ে। ফলে কর, ভ্যাট ও মূসকে কোথাও কোনো কিছু বাড়ানো হয়নি। শুধু ছাড় দেওয়া হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্যে শুধু রাজস্ব আদায় নয়। এর পাশাপাশি সরকারের আরও অন্যান্য চিন্তা আছে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের রাজস্ব নীতির যে ভিত্তি আছে সেটি কাজে লাগাতে পারলে এর ফল পাওয়া যাবে। 

কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, যখন আমি বলেছি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার চেষ্টা করব, তখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো তথ্য ছিল যে এই সুযোগ কতজন নিয়েছে। এখন এই সুযোগের সম্ভাবনাকে যাচাই করতে হবে। যদি এ উদ্যোগ লাভজনক হয় তাহলে এই সুযোগ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হবে। তবে এই মুহূর্তে এটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ফোন পেয়েছি যে, অনেকে বলছেন এক্ষেত্রে সমাজের ‘ইকুইটির জাস্টিস এনশিউর’ করা যাবে না যদি এটি অব্যাহত থাকে। তাই বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা আরও এক মাস এইটা দেখব। তারপর আলোচনা হবে।

তিনি আরও বলেন, এর ভালো দিক এবং খারাপ দিক আছে। ভালো দিক হচ্ছে কালোটাকা অর্থনীতির সিস্টেমেই নাই, এটি ব্যবহার করতে পারি না। এটি যদি প্রদর্শিত আয় হিসাবে চলে আসে তাহলে ব্যবহার করা যাবে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। আর খারাপ দিক হচ্ছে এটি সমাজের সম্পদের প্রতি অবিচার হবে।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ও সক্ষমতা পর্যাপ্ত কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ খাত নিয়ে আমাদের ব্যবস্থাপনা করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে প্রশ্নের জবাব দিতে অর্থ সচিবকে নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী। পরে ফ্লোর নিয়ে অর্থ সচিব বলেন, এ বছর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ গত বরাদ্দের তুলনায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। বরাদ্দ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আগামী এক বছরে যে ভ্যাকসিন (টিকা) প্রয়োগ করা যাবে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাজেটে। সব মিলে ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা টিকা কেনা বাবদ রাখা হয়েছে। প্রয়োজন হলে অন্য খাত থেকে সরবরাহ করা যাবে।

অর্থসচিব আরও জানান, বরাদ্দ অব্যয়িত বিষয়ে দুটি সমস্যা শনাক্ত করা হয়েছে। আগামী বছর থেকে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা চাহিদার ভিত্তিতে করা হবে। এজন্য একটি সমীক্ষা করা হচ্ছে যে দেশে যতগুলো সরকারি হাসপাতাল আছে সেগুলোর কী অবস্থা। আগে কেনাকাটা হতো সরবরাহের দিক থেকে এটি এখন চাহিদার দিকে আনা হবে। এ ছাড়া টাকা ব্যয় ও কেনাকাটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পরিচালকরা সংশ্লিষ্ট। তাদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। এটি হলে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে তা বন্ধ হবে।

স্বাস্থ্য খাত প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম, এটি সবাই বলছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলেছেন, টাকা কোনো সমস্যা নেই। অন্য স্থান থেকে কেটে হলেও স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া হবে। ফলে বরাদ্দ নিয়ে ভুল বুঝার কিছু নেই।

প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে এই অর্জন কিভাবে সম্ভব জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির গতি ধারা ইতিবাচক আছে। ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪০ শতাংশের নিচে। যেখানে চীন ১শ শতাংশের বেশি। ফলে ঘাটতি বাজেট নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এটি বহন করা যাবে।

করোনায় চাকরি হারানোর তাৎক্ষণিক কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাজেটে-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ সচিব বলেন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অষ্টম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ প্রকল্প বেশি বাস্তবায়ন হলে মানুষের চাকরি হবে। অপর দিকে করপোরেট করসহ অন্যান্য কর কমানো হয়েছে। মূলত এর উদ্দেশ্য মানুষ বিনিয়োগ করবে। আর বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সুতরাং যারা চাকরি হারিয়েছেন করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে তারা আগামী পাঁচ মাসের মধ্যেই চাকরি পাবেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. শামসুল আলম বলেন, বর্তমান জিডিপির অনুপাতে ৩১ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এটি বিনিয়োগ বুষ্ট করতে করা হয়েছে। কর ছাড় দিয়ে সরকার ঝুঁকি নিয়েছে। এটি মূলত বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য। কারণ বেসরকারি খাত থেকে ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ আসে। অর্থনীতির চালকের আসনে বেসরকারি খাত থাকলে, তাকে আরও শক্তিশালী করতে কর ছাড়সহ নানা উদ্যোগ দেওয়া হলে আরও ভালো হবে। সব মিলে অর্থনীতিতে চাঙ্গা ও ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এ বাজেট অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে।

প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে বাজেট বক্তব্যে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি-এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, প্রতিটি প্যাকেজের তিন বছর মেয়াদ আছে। এসব প্যাকেজ শেষ হলে ব্যাংক পুনরায় ঋণ নিতে পারবে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায়। ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৮০ শতাংশ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকিং খাত থেকে। গভর্নর আরও বলেন, ঘাটতি পূরণে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে সমস্যা হবে না। কারণ বর্তমান ব্যাংকিং খাতে উদ্ধৃত্ত তারল্য রয়েছে দুই লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদ রয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে ব্যাংকগুলো।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, উত্তরণের অনেক কিছুই নির্ভর করছে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসার ওপর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে মানুষের কাজ পেতে বেশি সময় লাগবে না বলেই তার বিশ্বাস।